|| জঙ্গলমহলের অন্ত:পুরে ||



শুরুটা হয়েছিল এভাবেই "এবার শ্রাবণে ভাবনার অপচয়,কলকারখানা ভাসিয়ে দিয়েছি জলে।" তাই ভাবনার বেশী কিছু অপচয় না করেই,বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসে উপস্থিত হলাম পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে।আবহাওয়া দপ্তর থেকে যদিও ততক্ষণে ঘোষিত হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের একটি সাইক্লোনের প্রভাবে যে নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়েছে তা মোটামুটি ৪৮ ঘন্টা স্থায়ী হবে এবং তার আগে থেকেই প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুণ কলকাতা ভেনিসে রুপান্তরিত হয়েছিল।বিপদের আশংকা আগে থেকে উপলব্ধি করেই সকাল ৭টার ট্রেন ধরার জন্য বাড়ি থেকে ভোর সারে চারটের সময়েই বেড়িয়ে পড়েছিলাম।না হে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত।

আজ থেকে ১৬-১৭ বছর আগে একবার ঝাড়্গ্রাম এসেছিলাম।বাবার সাথে স্কুটারে করে।বাবার অভ্যাস ছিল মাঝেমধ্যেই স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে পড়া।বিপদআপদের কথা কোনোদিনই তিনি ভাবতেন না।অবশ্য তখনকার দিনে বিপদআপদ মানুষের বেশী কিছু হতোও না।তাই ছোট্টবেলার ঝাড়্গ্রামের স্মৃতি হিসেবে শুধু এটুকুই মনে ছিল যে এক গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাত্রিবেলা বাবার সাথে স্কুটারে বসে যাচ্ছি,আর পথ যেখানে শেষ হলো,দেখতে পেলাম এক বিরাট রাজপ্রাসাদ।



এতো গেল সেই ১৬-১৭ বছর আগের কথা।তারপর সময় নদীতে কতজল বয়ে গেছে।পরিবর্তন হয়েছে কতোকিছুর।লাল হয়ে গেছে সবুজ,কমরেড সরে গিয়ে ভীড় করেছে দিদিপন্থীরা আর তার সাথে এলো মাওবাদীরা এবং ঝাড়্গ্রাম,বেলপাহাড়ির নাম পরিবর্তন হয়ে এক কুখ্যাত নামকরণ হলো জঙ্গলমহল।ভাবতে অবাক লাগে তিন-চার বছর আগেও এই জঙ্গলমহল ছিল সাধারণ মানুষের বধ্যভূমি।তবে দিদি ক্ষমতায় আসার পরে আর কিষাণজির মারা যাওয়ার পর,মাওবাদীদের দল ভেঙেই গেছে বলাযায়।যদিও এখানে আসার দুদিন আগেও খবরে পড়েছিলাম কাঁকড়াঝোরে আবার কিছু মাওবাদী এসে উপস্থিত হয়েছে।তবুও এলাম ঝাড়্গ্রামকে থুড়ি জঙ্গলমহলকে নতুনভাবে চিনে নিতে।


ম্যাপ দেখে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে কোনদিন কোন জায়গায় যাবো।ঝাড়গ্রামে আমার বন্ধু সৌম্যদীপের বাড়ি হওয়ায় বেশ সুবিধাই হয়েছিল।দুদিন ওর গাড়ী করেই পুরো জঙ্গলমহল চষে বেড়িয়েছিলাম।
প্রথমদিন আমাদের তৈরী করা তালিকা অনুযায়ী ঘোরার জায়গাগুলো ছিল যথাক্রমে :
বেলপাহাড়ি।
ঘাগড়া জলপ্রপাত।
তারাফেনী নদী।
গুরাসিনি।
লালজল পাহাড়।
কেতকী জলপ্রপাত।
কাঁকড়াঝোর।



আমরা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম দুপুর ১২টার সময়।বেলপাহাড়ি যখন পৌছলাম তখন বৃষ্টি অনেক কমে গেছে।জামপুর,বিনপুর,শিলদা,গুরাসিনি হয়ে আসতে হয় এইএই বেলপাহাড়িতে।বেলপাহাড়ি ঝাড়্গ্রাম থেকে ৬০কিমি দূরে এবং বেলপাহাড়িই মূলত বাকি জায়গাগুলোর সংযোগস্থল।আমরা প্রথমে গেছিলাম কাঁকড়াঝোর,যার ওপর মাওবাদীদের রাজত্ব চলতো এক সময়।বেলপাহাড়ি থেকে কাঁকড়াঝোর ১৮-১৯কিমি দূরে।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন দেখলাম বেলপাহাড়ি থেকে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার পথে।পথের দুপাশে ঘন জঙ্গল।শাল,পিয়াল,কেন্দু,শিমুল,বোহেরা,হরিতকী ইত্যাদি অনেক গাছ পথেত দুপাশে দেখতে পাওয়া যায়।কাঁকড়াঝোর যখন পৌছলাম তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টি এবং সেই ঘন অরণ্য আর তার মধ্যে গাড়ি নিয়ে আমরা চলছি সঠিক গন্তব্যস্থল কি সেটা আমরা কেউ ই জানিনা,সত্যজিৎ রায় এর অরণ্যের দিনরাত্রি মুভিটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।"happiness is a way of travel – not a destination.” Hidden India এর এটাও এক নতুন রুপ।এখানেই আমি ময়ূরের দরশন পাই এবং সেটার ছবিও তুলে রেখেছিলাম।



কাঁকড়াঝোর থেকে আরো দুটো জিনিষ দেখতে আমরা গেছিলাম- কেতকী ঝর্ণা এবং কানাইসর পাহাড়।
কানাইসোর পাহাড় রাস্তা থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম।আর কেতকী ঝর্ণা আমরা গাড়ি নিয়ে পৌছেছিলাম।বেশ কিছু গ্রাম দেখতে পেয়েছিলাম সেই রাস্তায়।গ্রামের বেশকিছু মানুষের সাথে আলাপও হয়েছিল।সিংহডোবা আর বুড়িঝোর এই দুই গ্রামের মধ্যে কেতকীর অবস্থান।ওদোলচুয়া থেকে ৪কিমি দূরে।লালমাটির ওপর দিয়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারা কেতকীকে করে তুলেছে পরিপূর্ণ।সাধে কি আর কবিগুরু লিখে রেখে গেছিলেন "নব যৌবনা বরষা"।

এরপর কেতকী থেকে আমরা গেলাম ঘাগরা জলপ্রপাত এবং তারাফেনী ব্যারেজ দেখতে।ঘাগড়া জলপ্রপাত বেলপাহাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ৯কিমি দূরে অবস্থিত।ভরা শ্রাবণে বৃষ্টির জলে বলীয়ান হয়ে উঠেছে দেখলাম ঘাগরা জলপ্রপাত।জলের ধারা এবং তার বিপুল জলরাশি ভাসিয়ে দিয়েছে দেখলাম কিছু শাখাপথকে।
ঘাগরা থেকে যখন আমরা কেতকী ব্যারেজ দেখতে যাচ্ছিলাম তখন বেশ কিছু গ্রামের মধ্যে দিয়ে ঘুরেছিলাম এবং তখন সেই গ্রামে বুনো হাতীর আক্রমণ ঘটে।যদীও হাতী দেখার সময় আমাদের ছিল না এবং "য পলায়তি স জীবতি" শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে আমরাও রণে ভঙ্গ দিলাম সেদিনের মতো।সেদিনের মতো আমাদের ঝাড়্গ্রামের একদিক ঘোরা শেষ হলো।

পরেরদিন আমরা আবার বেড়াতে বেড়লাম সকাল ৯টা নাগাদ।আর এবার গাড়ি আমাকেই চালাতে হলো কারণ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার তাদের গ্রামে বন্যা এসে যাওয়ার দরুণ আর আসতে পারে নি সকালে।যাই হোক জয় মা বলে বেড়িয়েই পড়লাম সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে।লক্ষ্য করলাম বৃষ্টি কিছুটা কমেছে।আমাদের ঝাড়্গ্রাম ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনের গন্তব্যস্থানগুলি ছিল যথাক্রমে :
ঝাড়্গ্রাম রাজবাড়ি।
চিল্কিগড় রাজবাড়ি।
কনক দূর্গা মন্দির।
রামেশ্বর মন্দির।



আমরা দ্বিতীয় দিনের যাত্রা শুরু করি ঝাড়্গ্রাম রাজবাড়ি থেকে।শহর থেকে বেশ দূরে কলাবনী জঙ্গলের কাছে এই রাজবাড়ি ১৭৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।সেই রাজবাড়ি যেখানে ছোটোবেলায় বাবার সাথে এসে ছিলাম।পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে কত ভাল লাগে।
ঝাড়্গ্রাম রাজবাড়ি ঘুরে আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্যস্থলটি ছিল রামেশ্বর মন্দির।কলাবনী জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যখন এন এইচ সিক্সে এসে পড়ি ততক্ষণে আমরা Far from the madding crowed.
ঝাড়্গ্রাম থেকে ৬৪কিমি দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি গোপিবল্লভপুর যাওয়ার পথে পড়ে।মন্দিরটি সুবর্ণরেখা নদীর ধারে অবস্থিত।আমাদের যাত্রাপথে সুবর্ণরেখা নদীর ওপর সিধু কানু বিরসা সেতু আমরা পেড়িয়েছিলাম।কথিত আছে সীতা রামচন্দ্রের কাছে অনুরোধ করেছিলেন বিশ্বকর্মার সাহায্য নিয়ে ভগবান শিবের পূজার জন্য এই মন্দিরটি বানাতে।মন্দিরের স্থাপত্যকলা আমাদের অবাক করে দিয়েছিল।মন্দিরে কোনো জানলা নেই সূর্যের আলো ঢোকার জন্য।তবুও মন্দিরটিকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যে তার ভিতর আলো এসে পড়বেই।সেই স্থাপত্যকলার বিবরণ আমি দিতে চাই না।এই জিনিষ শুধু চোখে দেখেই উপলব্ধি করা যায়।
রামেশ্বর মন্দির থেকে ৮কিমি দূরে তপোবন নামে একটি জায়গা ছিল।কথিত আছে সীতা এখানেই তাঁর দুই ছেলে লব এবং কুশকে নিয়ে থাকতেন।

রামেশ্বর মন্দির দেখার পরে আমরা যাই কনক দূর্গা মন্দিরটি দেখার জন্য।এই মন্দিরটি দেখতে যাওয়ার পথেই আমরা দেখতে পাই ডুলুং নদীকে।বরষাকাল ছাড়া এই নদীতে জল তেমন থাকেই না বলা যায়।যদীও আমরা চিল্কিগড় রাজবাড়ি যেতে পারিনি এই নদীর জন্যই।কারণ চিল্কিগড় যাওয়ার পথে যে সেতুটি পরে,সেটির সম্পূর্ণভাবে সলিল সমাধি ঘটেছিল।কনক দূর্গা মন্দিরটি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম বেশ কয়েকশো বছরের পুরোনো।স্থানীয় লোকজনদের মতে দেবী খুবই জাগ্রত।দূর দূর থেকে লোকজন আসে এই মন্দিরে পূজো দিতে।মূল মন্দিরটি লক্ষ্য করলাম ভেঙ্গে গিয়েছে এবং মূল মন্দিরের পাশে নতুন একটি মন্দির স্থাপন করা হয়েছে।কনক দূর্গা মন্দিরে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পড়ে মনে পড়লো ফেরার ট্রেন ধরার সময় হয়ে গেছে আবার।



এবার জঙ্গলমহলকে বিদায় জানানোর পালা।বুঝতে পারছিলাম দুদিনেই খুব একাত্ম হয়ে গেছিলাম জঙ্গলমহলের মাটি,বাতাস,মানুষের সাথে।যদিও জানি এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো,ফিরে আবার আসতেই হবে মাটির টানে,মাটির কাছে।আবার কোনো একএক বরষার দিনে,কোনো বন্ধুর হাত ধরে।
ততোদিন ভালো থেকো জঙ্গলমহল।

(পুনশ্চ : শহরে ফিরে রোটারী ক্লাবের আলোচনা সভায় এবং বিভিন্ন এন.জি.ও এর অধিবেশনে "দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর" বলে যতোই মাথা চাপড়ানো শুনি,শেষ অবধি আমরা মনে সেই জিনিষটা কি আদৌ উপলব্ধি করি?)

5 Comments

  1. Pics r lekha dutoi daroon..aroh notun kichu dekhar opekhay roilam..:)

    ReplyDelete
  2. Thank you Ppiya,Soumajit,Sanu,Arnab .
    Please follow my blog .

    ReplyDelete
  3. Sayan tui ei blog ta likhe amader jaoa ta sarthak korli.thanks

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post