এই অদ্ভূত বুদ্ধিটা আমারই ছিল।তবে ঠিক অদ্ভূত না।সারাদিন অফিসে বসে বসে যখন আর ভালো লাগত না,তখন বিভিন্ন ঘোরার জায়গার ফটো দেখতাম,জায়গাগুল নিয়ে পড়তাম।এইরকমই একদিন একটা ওয়েব সাইটের মধ্যে গড়পঞ্চকোট নামের জায়গার প্রথম ছবি দেখতে পাই।আহামরি ছবি কিছু না অনেকেই হয়ত দেখে বলবেন।একটা পুরনো ভাঙাচোরা মন্দিরের ছবি একটা ফাঁকা জায়গায়।তবুও জানিনা কেন মনটা টেনেছিল।বরাবরই জানতাম পশ্চিমবঙ্গে অনেক ঘোরার জায়গা আছে যেগুল না দেখে বা যেগুলর সম্বন্ধে না জানার ফলে আমরা বারবারই ছুটে যাই সিকিম উত্তরাখন্ড হিমাচলপ্রদেশ।ব্যাপারটা অনেকটা সেই "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,একটি ধানের শিষের উপর,একটি শিশির বিন্দু"র মতোনই।যাই হোক যখন খুঁজে পেলাম গড়পঞ্চকোট তখন মাথায় বেশ চেপেই বসল জায়গাটা।আমার ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারে অফিস আর এমনি বন্ধুদের গ্রুপ ছাড়াও আরো একটি গ্রুপ আছে,সেটা হলো আমার ফ্যামিলী গ্রুপ।বেশী বড়ো না,আমি মা বাবা,ভারত সরকারের "ছোটা পারিভার সুখি পারিভার" বিজ্ঞাপনটির মতোন।বাবা আর আমি দুজনেই গাড়ি চালিয়ে মাঝে মাঝেই অনেকদূরের পথে পাড়ি দিতে ভালবাসি।তাই এই অজানা জায়গাটায় যাওয়ার প্রস্তাবটা বাবার সামনেই রাখলাম।বাবাও গুগল থেকে ফটোগ্রাফগুল দেখে যাওয়ার কথায় রাজি হয়ে গেল।বাকি রইল মা,মা এমনিতেই বেড়াতে ভালবাসে ভীষণ।তাই বেশি দেরী না করে আমরা তিনজন বেড়িয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে এক গ্রীষ্মের সকালে।
কারল সাগান একবার বলেছিলেন "I don't know where I am going but I'm on my way".রাস্তায় বেরলেই ওনার এই কথাগুল আমার মাথায় ঘুরতো আর ভীষণ ভালও লাগতো।আমরা সকাল সকাল বেড়িয়ে পরেছিলাম গড়পঞ্চকোটের জন্য।গড়পঞ্চকোট মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় অবস্থিত,পাঞ্চেট পাহাড়ের ঠিক নীচে।পাঞ্চেট পাহাড়টির অবস্থান ছোটোনাগপুর মালভূমির একেবারে নীচের অংশে।কলকাতা থেকে এই জায়গার দূরত্ব ২৭০ কিমি।আমরা কোথাও বেড়াতে গেলেই সাধারণত রোডম্যাপ বের করে রাখি,গাড়ি চালাতে সুবিধা হয় অনেক। এবারেও আমি আর বাবা ম্যাপ দেখে দেখেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম।একে একে পেড়িয়ে গেলাম শক্তিগড়,বর্ধমান।পানাগড়ের কাছে রাস্তা একটু খারাপ হলেও পরে দূর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটতে লাগল তীর বেগে।ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছিল চোখে মুখে।মাঝে রাস্তার ধারে এক ধাবায় আমরা খাওয়ার খেয়ে নিয়েছিলাম।রাণীগঞ্জ থেকে স্টিয়ারিং ধরলাম আমি আর বাবা ধরল রোডম্যাপ।আসানসোল যখন পৌছলাম তখন বেলা ১০:৩০ বেজে গেছে।ভূগোল বইতে পড়া সেই আসানসোল, জটায়ুর ভাষায় এক পাওয়ারফুল প্লেস যাকে বলা যায়।আসানসোল হয়ে পাঞ্চেট ড্যাম পার করে আবার আমরা এসে ঢুকলাম পশ্চিমবঙ্গে, অর্থাৎ পুরুলিয়ায়।পাঞ্চেট ড্যাম শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ায় মাইথন ড্যামের মত নয়,বেশ লোকজনবিহীন।খুবই সুন্দর ড্যাম,দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশনের তৈরী করা এটাই শেষ ড্যাম।ড্যামের ওপর থেকে গাড়ি চালাতে চালাতে দেখলাম অনেক বড় ফুলের বাগান তৈরী করা আছে ড্যামের পাশেই আর সকালের রোদ্দুরে দামোদর নদীর জল চিকচিক করছে।
আমরা কোনরকম হোটেল না দেখে না বুক করে বেড়িয়ে পড়েছিলাম।তাই বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে কোনো হোটেল যখন পেলাম না গোদা বাংলায় বুঝলাম কেস খেয়েছি।পরে স্থানীয় একজনের কাছ থেকে জানলাম যে এইখানে থাকার দুটি মাত্র জায়গা আছে।এক হলো পাঞ্চেট রেসিডেন্স যেটি পাঞ্চেট ড্যাম থেকে ১০ মিনিট দূরেই ছিল এবং এটার পাশেই আর একটি থাকার জায়গা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গড়পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র।দ্বিতীয়টি আগে থেকে বুক করে আসতে হতো তাই আমাদের ঠাঁই হলো প্রথমটিতেই।পাঞ্চেট রেসিডেন্সী হোটেল ঠিক বলা চলেনা, ছোটো ছোটো কটেজ নিয়ে তৈরী একটি ইকো-ভিলেজ এবং একেবারে পাঞ্চেট পাহাড়ের ঠিক পিছন দিকে।মুদ্ধ হয়ে গেছিলাম এই ইকো-ভিলেজে ঢুকে।সামনের পাঞ্চেট পাহাড়টা মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলব আর ডান দিকে ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে এক বিশাল বড়ো অরণ্য ।সত্যি বলতে কি এতো কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে এসে থাকার জন্য এইরকম মনোরম পরিবেশ পেয়ে মনটা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল।ভিলেজের ম্যানেজার জানান এই ভিলেজটির নাম ওনারা দিয়েছেন ভিলেজ টেলকুপি।থাকার জায়গা হলো ভিলেজেরই এক কুঁড়েঘরে।হাসবেন না।নামেই কুঁড়েঘর।ভিতরে টি.ভি,রুম হীটার,এ.সি,ফ্রীজ কি নেই।ভীষণই অবাক হয়েছিলাম এবং মনে মনে প্রশংসা করছিলাম তার, যিনি এইরকম ভাবে ভিলেজটি বানিয়েছেন।খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও খুবই সুন্দর ছিল।ম্যানেজারই বললেন পাহাড়ের ঠিক নীচে হওয়ার দরুণ সকালে এ.সির দরকার পড়লেও রাতে রুমে হীটার চালাতে হবে।সেদিন গাড়ি চালিয়ে বেশ ক্লান্ত ছিলাম আমরা আর তারপর ভাল ভাল খাবার খাওয়ার পর বিশ্রাম নিতে কটেজে ঢুকে পড়ি।
বিকেলবেলা যখন বেরোলাম ভিলেজের ভিতর বাতিস্তম্ভের আলোগুল জ্বলে উঠেছে।সামনের পাঞ্চেট পাহাড়টা বেশ মায়াবী লাগছিল সেই আলোয়।চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে। "পাহাড় শেখায় তাহার সমান হই যেন ভাই মৌন মহান" তাই না?
সন্ধ্যাবেলায় আমি আর বাবা অনেক্ষণ টেনিস খেললাম।ভিলেজের ভেতর টেনিস কোর্ট,ক্রিকেট খেলার জায়গা বোটিং এরও ব্যবস্থা ছিল।এরপর আমরা বসে প্ল্যান করে নিলাম পরেরদিন কোথায় কোথায় ঘুরবো।ম্যানেজারবাবুও অনেক সাহায্য করেছিলেন আমাদের এই প্ল্যান বানাতে।
পরেরদিন আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম সকাল সকাল গড়পঞ্চকোট মন্দিরের উদ্দ্যেশে।পুরুলিয়ায় গ্রীষ্মকালে বেশ গরম পরে যায় সকাল দশটার পর থেকেই।সেটা মাথায় রেখেই আমরা জলদি বেড়িয়ে পড়েছিলাম।১০-১৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পরেই আমরা মন্দিরে পৌছে যাই।তবে মন্দির বলা চলে না যেটা দেখেছিলাম।মন্দিরের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলাম।গড় মানে বাংলায় যাকে বলে কেল্লা ইংরাজীতে যাকে বলে Fort।কথিত আছে কাশীপুরের রাজা এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।যদিও এই নিয়ে মতভেদ আছে।অনেকে এটাও বলেন যে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পুরান এই মন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছিল সিং-দেও এর রাজত্বকালে।এখানে এই মন্দিরের আসেপাশে যেসব স্থাপত্যশৈলী দেখা যায় সেগুলর কয়েকটি প্রকার হলো পঞ্চরত্ন,জোড়-বাংলা, পৃথা।এই মন্দিরটি পঞ্চরত্ন স্থাপত্যকলার নিদর্শন। যদিও স্থানীয় মানুষজন আমাকে বলেছিল পুরাকালে এই মন্দিরটি রাধা-গোবিন্দর মন্দির ছিল।আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধুলামন্দির কবিতাটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, "ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পরে,বন্ধ দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে"। আমরা বেশ কিছুক্ষণ মন্দিরের আসেপাশে ঘুরে তারপর পাঞ্চেট ড্যাম দেখতে চলে যাই।আগেই বলেছিলাম পাঞ্চেট ড্যাম এর পাশে একটি সুন্দর ফুলের বাগান দেখেছিলাম।সেই ফুলের বাগানে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছিল।কিছু ফুলের নাম জানতাম আর অনেক ফুলের নাম জানতাম না।কিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে আবার ফিরে এলাম আমরা ইকো-ভিলেজে।সূর্যদেব তখন মধ্য গগনে এসে গেছেন।
দুপুর বেলা খাওয়ার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আমরা বেড়িয়ে পরলাম বারান্তির দিকে।বারান্তি ১০-১৫ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট শান্ত সুন্দর একটি গ্রাম।গ্রামের প্রতিটি বাড়ির গায়ে কারুকার্য করা ছবি আঁকা।কিছুটা দূরে মস্ত বড়ো একটা জলাশয় দেখা যাচ্ছিল,বারান্তি জলাশয়।২ কিলোমিটার লম্বা একটি ড্যাম সেখানে ছিল বারান্তি জলাশয়ের ওপর। আমাদের মতো টুরিস্টরা নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত দেখার লোভেই এই বারান্তিতে ভীর করত।বারান্তি জলাশয়টি মুরাডি এবং বারান্তি এই দুটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।আমরাও পৌছেছিলাম সূর্যাস্তের সময়ই।চারদিকটা ভীষণ শান্ত লাগছিল।ড্যামের ওপর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে রইলাম।সামনে দুই পাহাড়ের ফাঁকে আস্তে আস্তে সূর্যাস্ত হচ্ছিল জলে তার লাল আভা পড়ে ঠিকরে বেরচ্ছিল আর ছড়িয়ে পড়ছিল আমাদের চোখে মুখে। পড়ন্ত সূর্যের আলোর শেষ বিন্দুটুকু যতক্ষণ দেখা গেছিল, দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম।"সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন..." ভাবতে ভাবতে গাড়ির এক্সিলারেটরে হাল্কা চাপ দিলাম।
পরেরদিন ছিল ঘরে ফেরার পালা।জীবনের আর দুটো দিন কত দ্রুততার সাথে চলে গেল ভাবতে ভাবতে ফেরার পথে পা বাড়ালাম।মনে থাকবে গড়পঞ্চকোট,মনের ভিতর আঁকা থাকবে ছবি যে কোনো এক সময়ে সেখানেও জ্বলতো দীপ রাধা-গোবিন্দর মূর্তীর সামনে এবং মনে থাকবে বারান্তির সূর্যাস্তের শেষ আলোকবিন্দু।মনে থাকবে।
কারল সাগান একবার বলেছিলেন "I don't know where I am going but I'm on my way".রাস্তায় বেরলেই ওনার এই কথাগুল আমার মাথায় ঘুরতো আর ভীষণ ভালও লাগতো।আমরা সকাল সকাল বেড়িয়ে পরেছিলাম গড়পঞ্চকোটের জন্য।গড়পঞ্চকোট মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় অবস্থিত,পাঞ্চেট পাহাড়ের ঠিক নীচে।পাঞ্চেট পাহাড়টির অবস্থান ছোটোনাগপুর মালভূমির একেবারে নীচের অংশে।কলকাতা থেকে এই জায়গার দূরত্ব ২৭০ কিমি।আমরা কোথাও বেড়াতে গেলেই সাধারণত রোডম্যাপ বের করে রাখি,গাড়ি চালাতে সুবিধা হয় অনেক। এবারেও আমি আর বাবা ম্যাপ দেখে দেখেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম।একে একে পেড়িয়ে গেলাম শক্তিগড়,বর্ধমান।পানাগড়ের কাছে রাস্তা একটু খারাপ হলেও পরে দূর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটতে লাগল তীর বেগে।ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছিল চোখে মুখে।মাঝে রাস্তার ধারে এক ধাবায় আমরা খাওয়ার খেয়ে নিয়েছিলাম।রাণীগঞ্জ থেকে স্টিয়ারিং ধরলাম আমি আর বাবা ধরল রোডম্যাপ।আসানসোল যখন পৌছলাম তখন বেলা ১০:৩০ বেজে গেছে।ভূগোল বইতে পড়া সেই আসানসোল, জটায়ুর ভাষায় এক পাওয়ারফুল প্লেস যাকে বলা যায়।আসানসোল হয়ে পাঞ্চেট ড্যাম পার করে আবার আমরা এসে ঢুকলাম পশ্চিমবঙ্গে, অর্থাৎ পুরুলিয়ায়।পাঞ্চেট ড্যাম শহর থেকে বেশ দূরে হওয়ায় মাইথন ড্যামের মত নয়,বেশ লোকজনবিহীন।খুবই সুন্দর ড্যাম,দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশনের তৈরী করা এটাই শেষ ড্যাম।ড্যামের ওপর থেকে গাড়ি চালাতে চালাতে দেখলাম অনেক বড় ফুলের বাগান তৈরী করা আছে ড্যামের পাশেই আর সকালের রোদ্দুরে দামোদর নদীর জল চিকচিক করছে।
আমরা কোনরকম হোটেল না দেখে না বুক করে বেড়িয়ে পড়েছিলাম।তাই বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে কোনো হোটেল যখন পেলাম না গোদা বাংলায় বুঝলাম কেস খেয়েছি।পরে স্থানীয় একজনের কাছ থেকে জানলাম যে এইখানে থাকার দুটি মাত্র জায়গা আছে।এক হলো পাঞ্চেট রেসিডেন্স যেটি পাঞ্চেট ড্যাম থেকে ১০ মিনিট দূরেই ছিল এবং এটার পাশেই আর একটি থাকার জায়গা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গড়পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র।দ্বিতীয়টি আগে থেকে বুক করে আসতে হতো তাই আমাদের ঠাঁই হলো প্রথমটিতেই।পাঞ্চেট রেসিডেন্সী হোটেল ঠিক বলা চলেনা, ছোটো ছোটো কটেজ নিয়ে তৈরী একটি ইকো-ভিলেজ এবং একেবারে পাঞ্চেট পাহাড়ের ঠিক পিছন দিকে।মুদ্ধ হয়ে গেছিলাম এই ইকো-ভিলেজে ঢুকে।সামনের পাঞ্চেট পাহাড়টা মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলব আর ডান দিকে ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে এক বিশাল বড়ো অরণ্য ।সত্যি বলতে কি এতো কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে এসে থাকার জন্য এইরকম মনোরম পরিবেশ পেয়ে মনটা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল।ভিলেজের ম্যানেজার জানান এই ভিলেজটির নাম ওনারা দিয়েছেন ভিলেজ টেলকুপি।থাকার জায়গা হলো ভিলেজেরই এক কুঁড়েঘরে।হাসবেন না।নামেই কুঁড়েঘর।ভিতরে টি.ভি,রুম হীটার,এ.সি,ফ্রীজ কি নেই।ভীষণই অবাক হয়েছিলাম এবং মনে মনে প্রশংসা করছিলাম তার, যিনি এইরকম ভাবে ভিলেজটি বানিয়েছেন।খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও খুবই সুন্দর ছিল।ম্যানেজারই বললেন পাহাড়ের ঠিক নীচে হওয়ার দরুণ সকালে এ.সির দরকার পড়লেও রাতে রুমে হীটার চালাতে হবে।সেদিন গাড়ি চালিয়ে বেশ ক্লান্ত ছিলাম আমরা আর তারপর ভাল ভাল খাবার খাওয়ার পর বিশ্রাম নিতে কটেজে ঢুকে পড়ি।
বিকেলবেলা যখন বেরোলাম ভিলেজের ভিতর বাতিস্তম্ভের আলোগুল জ্বলে উঠেছে।সামনের পাঞ্চেট পাহাড়টা বেশ মায়াবী লাগছিল সেই আলোয়।চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে। "পাহাড় শেখায় তাহার সমান হই যেন ভাই মৌন মহান" তাই না?
সন্ধ্যাবেলায় আমি আর বাবা অনেক্ষণ টেনিস খেললাম।ভিলেজের ভেতর টেনিস কোর্ট,ক্রিকেট খেলার জায়গা বোটিং এরও ব্যবস্থা ছিল।এরপর আমরা বসে প্ল্যান করে নিলাম পরেরদিন কোথায় কোথায় ঘুরবো।ম্যানেজারবাবুও অনেক সাহায্য করেছিলেন আমাদের এই প্ল্যান বানাতে।
পরেরদিন আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম সকাল সকাল গড়পঞ্চকোট মন্দিরের উদ্দ্যেশে।পুরুলিয়ায় গ্রীষ্মকালে বেশ গরম পরে যায় সকাল দশটার পর থেকেই।সেটা মাথায় রেখেই আমরা জলদি বেড়িয়ে পড়েছিলাম।১০-১৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পরেই আমরা মন্দিরে পৌছে যাই।তবে মন্দির বলা চলে না যেটা দেখেছিলাম।মন্দিরের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলাম।গড় মানে বাংলায় যাকে বলে কেল্লা ইংরাজীতে যাকে বলে Fort।কথিত আছে কাশীপুরের রাজা এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।যদিও এই নিয়ে মতভেদ আছে।অনেকে এটাও বলেন যে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পুরান এই মন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছিল সিং-দেও এর রাজত্বকালে।এখানে এই মন্দিরের আসেপাশে যেসব স্থাপত্যশৈলী দেখা যায় সেগুলর কয়েকটি প্রকার হলো পঞ্চরত্ন,জোড়-বাংলা, পৃথা।এই মন্দিরটি পঞ্চরত্ন স্থাপত্যকলার নিদর্শন। যদিও স্থানীয় মানুষজন আমাকে বলেছিল পুরাকালে এই মন্দিরটি রাধা-গোবিন্দর মন্দির ছিল।আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধুলামন্দির কবিতাটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, "ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পরে,বন্ধ দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে"। আমরা বেশ কিছুক্ষণ মন্দিরের আসেপাশে ঘুরে তারপর পাঞ্চেট ড্যাম দেখতে চলে যাই।আগেই বলেছিলাম পাঞ্চেট ড্যাম এর পাশে একটি সুন্দর ফুলের বাগান দেখেছিলাম।সেই ফুলের বাগানে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছিল।কিছু ফুলের নাম জানতাম আর অনেক ফুলের নাম জানতাম না।কিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে আবার ফিরে এলাম আমরা ইকো-ভিলেজে।সূর্যদেব তখন মধ্য গগনে এসে গেছেন।
দুপুর বেলা খাওয়ার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আমরা বেড়িয়ে পরলাম বারান্তির দিকে।বারান্তি ১০-১৫ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট শান্ত সুন্দর একটি গ্রাম।গ্রামের প্রতিটি বাড়ির গায়ে কারুকার্য করা ছবি আঁকা।কিছুটা দূরে মস্ত বড়ো একটা জলাশয় দেখা যাচ্ছিল,বারান্তি জলাশয়।২ কিলোমিটার লম্বা একটি ড্যাম সেখানে ছিল বারান্তি জলাশয়ের ওপর। আমাদের মতো টুরিস্টরা নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত দেখার লোভেই এই বারান্তিতে ভীর করত।বারান্তি জলাশয়টি মুরাডি এবং বারান্তি এই দুটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।আমরাও পৌছেছিলাম সূর্যাস্তের সময়ই।চারদিকটা ভীষণ শান্ত লাগছিল।ড্যামের ওপর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে রইলাম।সামনে দুই পাহাড়ের ফাঁকে আস্তে আস্তে সূর্যাস্ত হচ্ছিল জলে তার লাল আভা পড়ে ঠিকরে বেরচ্ছিল আর ছড়িয়ে পড়ছিল আমাদের চোখে মুখে। পড়ন্ত সূর্যের আলোর শেষ বিন্দুটুকু যতক্ষণ দেখা গেছিল, দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম।"সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন..." ভাবতে ভাবতে গাড়ির এক্সিলারেটরে হাল্কা চাপ দিলাম।
পরেরদিন ছিল ঘরে ফেরার পালা।জীবনের আর দুটো দিন কত দ্রুততার সাথে চলে গেল ভাবতে ভাবতে ফেরার পথে পা বাড়ালাম।মনে থাকবে গড়পঞ্চকোট,মনের ভিতর আঁকা থাকবে ছবি যে কোনো এক সময়ে সেখানেও জ্বলতো দীপ রাধা-গোবিন্দর মূর্তীর সামনে এবং মনে থাকবে বারান্তির সূর্যাস্তের শেষ আলোকবিন্দু।মনে থাকবে।