|| একটি পুরনো স্মৃতি,লাস্যময়ী নারী আর প্রচলিত গান ||

"ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন,চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন", দীঘা পুরী বা মন্দারমনি বেড়াতে গেলেই কবিগুরুর এই কবিতার কথা মনে পড়ে যায় রাশি রাশি বালুকণা দেখে।এবারের মন্দারমনি বেড়াতে আসাটা একটু অন্যরকম ছিল।একটু আলাদা ছিল অন্য সব বারের থেকে।এবারের মন্দারমনিটা যাওয়াটা ছিল কোনো পুরনো স্মৃতির টানে।কোনো পুরনো বন্ধুত্বকে তাজা করার জন্য।


চাকরী জীবনে যখন প্রথম ঢুকেছিলাম আজ থেকে তিন বছর আগে তখন অনেক বন্ধু বান্ধব পেয়েছিলাম।তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে পরে অন্তরঙ্গতা বেড়ে যাওয়ার সুবাদে একটা খুব ভাল দল পেয়ে গেলাম বেড়াতে যাওয়ার।আমাদের প্রথম বেড়াতে আসা হয়েছিল এই মন্দারমনিতেই।মন্দারমনি এখন আমাদের পশ্চিমবঙ্গ এর একটি প্রসিদ্ধ জায়গা।লোকজনের কম ভীড় এবং শান্ত সমুদ্র তীরের জন্য আজকাল অনেক বাঙ্গালী মন্দারমনিতেই বেশী আসতে চায়।প্রথমবার যখন এসেছিলাম দলটায় সাতজন ছিলাম।এবারে যখন এলাম পাঁচজন, গণেশ চলে গেছে বিদেশ আর সপ্তম জনকে নিয়ে কি বলবো,তার জন্যই আমার এবারে মন্দারমনি আসা।
আমাদের সপ্তম বন্ধুটা খুব মজার ছিল আর বেড়াতে খুব ভালবাসতো।প্রথমবারের মন্দারমনি ঘুরতে আসার কথাটাও অনির্বাণদা আর ও-ই প্রথম বলেছিল।অবশ্য বলেনি ও যখন বলতো তখন দাবীই রাখত আর সবাইকেই সেটা মানিয়েই ছাড়তো।আমরাও মেনেই যেতাম।
দেবাঞ্জনদা বলার পর এবারে অনেক টালবাহানা করলাম যাব কি যাব না।সাত পাঁচ ভেবে শেষ অবধি রাজী হয়েই গেলাম পুরনো সব স্মৃতির টানেই।এবারে গাড়ী নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা সকাল সকাল কারণ "প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন"।সোজা কথায় ফাল্গুন মাসের শেষের দিক হলেও "গরম তো এসে গেছে" বেশ অনুভব করতে পারছিলাম।

কোলাঘাট মেচেদা যখন পার হলাম বেশ ভালই গরম পরে গেছে।আমরা কোলাঘাটেই সকালের খাবার খেয়ে নি। একসময় ট্রেনে করে মেচেদা অবধি এসে বাস এ করে দীঘা যেতাম আর এখন পাকা পীচঢালা রাস্তায় একশোর কাছাকাছি গতিতে গাড়ি করে যাই।কে বলেছে পশ্চিমবঙ্গ এর সব খারাপ?
দুপুরবেলা যখন পৌছলাম চাউলখোলা বেশ ভালই লাগছিল।দুপুরবেলা বলে লোকজনও কম ছিল।চাউলখোলার ভিতর দিয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে মন্দারমনি পৌছলাম।হোটেলে ব্যাগ রেখেই সবাই ছুটলাম সমুদ্রে স্নান করতে।সেই জলের প্রতি মানুষের চিরন্তন আদি টান।স্নান করার সময় বিশেষ কিছু ঘটেনি শুধু একবার সৌভিকদা সমুদ্রে নেমে বলে উঠেছিল "জলটা একেবারেই মিষ্টি না"। স্নান করতে করতেই ডাবও খেয়ে ফেল্লাম আমরা।তারপর যখন হোটেলে ফিরলাম ততোক্ষণে পেটের ভেতর খিদের ডন-বৈঠক শুরু হয়ে গেছে।
খাওয়া-দাওয়ার পরে বেশী সময় আমরা পাইনি বিশ্রাম নেওয়ার। কারণ মন্দারমনিতে বা যেকোনো সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখার আমেজটাই আলাদা।সেটা যে দেখেছে সেই শুধু বুঝবে।তাই বেরিয়ে পরলাম মোহনার দিকে।


"ফিরে গেছে কত বোবা টানেলের গলা চিরে আলো ইচ্ছেরা ছুটে চলে" মোহনায় সূর্যাস্ত দেখতে এসে অনুপমের একটা গান মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার।আমরা কি আদৌ নিজেদের জন্য ছুটি বা ছুটলেও কতটা ছুটি আর যার জন্য ছুটি সেই ইচ্ছেগুলোকে কি পারি কোনদিন ধরতে?আবোলতাবোল ভাবছিলাম মোহনার দিকে হাঁটতে হাঁটতে।যদিও এসব ভাবার পিছনে "সারাটা দিন জুড়ে তুমি আনাগোনা করেছ সেই সুরে,তারই রং লেগে আছে"।কার রং? অর্নব এর, আমাদের সেই সপ্তম বন্ধু যাকে খুব কম বয়সেই চলে যেতে হয়েছে সবাইকে ছেড়ে।জীবনে যে শুধু দাম দিয়ে গেছে নিজের ইচ্ছেগুলোকে।আবার সেই পুরনো স্মৃতি।
সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মনটা আবার ভাল হয়ে গেল।ফিরে এলাম বাস্তবের মাটিতে।অনির্বাণদা একটার পর একটা ফটো তুলেই যাচ্ছিল ওর ক্যামেরায়।সৌভিকদার পাঞ্জাবিটা হাওয়ায় উড়ছিল।কেউ কেউ এটা বলতেই পারেন সমুদ্র সৈকত এবং বাঙ্গালির পাঞ্জাবি পরা still a better love story than twilight !! 
সূর্যাস্তের লাল আভা এসে পড়ছিল আমাদের চোখে মুখে আর ছড়িয়ে পড়ছিল সমুদ্রের জলে।সত্যই "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে"।
সূর্যাস্তের পর সবাই কাঁকড়া খেতে গেলাম একসাথে।সামুদ্রিক মাছও কিছু খেলাম।এরপর অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে যখন হোটেলে পৌছলাম তখন হোটেলের লন-এ উৎসব শুরু হয়ে গেছে।

হোটেলের সামনেই বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে দেখলাম ডিস্কো থেকের মত বানানো হয়েছে।নিয়ন আলোর ঝলকানি চতুর্দিকে।আমরা নিজেদের ঘরে গিয়ে সামনের বড়ো বারান্দায় বসে গল্প করতে লাগলাম আর আলোর ঝলক দেখতে লাগলাম।কিছু সময় পর লক্ষ্য করলাম আসর বেশ জমে উঠেছে এবং আসরে দুজন সুশ্রী তরুণীও দেখলাম যোগ দিয়েছে।তারপর শুরু হলো তাদের নাচাগানা।উদ্দাম নাচানাচি আর হিন্দী ফিল্মের উগ্র গান চলতে লাগল।বিরক্তিতে উঠে কিছুক্ষনের জন্য ঘরে চলে গেছিলাম।তারপর যখন বারান্দায় এলাম তখনো নাচাগানা চলছে।আর তারপর?
"নিয়ন আলোয় পণ্য হলো যা কিছু আজ ব্যক্তিগত"।


পরেরদিন ভোরবেলা উঠে আমি সৌভিকদা অনির্বাণদা সূর্যোদয় দেখতে গেছিলাম।অনেক ভোরেই উঠেছিলাম পাঁচটার সময়।কিন্তু এতো কিছু করেও ছ'টা বেজে যাওয়ার পরেও সূর্যদেবের দেখা আর পেলাম না।নিরাশ হয়েছিলাম একটু।তখনই সমুদ্রের হাল্কা বাতাস ঢেউ আর মেঘলা আবহাওয়ায় মনে পড়ে গেল আমার বনলতা সেনের কথা।বালিতে লিখেও দিলাম তার নাম।আর তারপরই হঠাৎ করে ঝলমলে রোদ উঠে গেল।সূর্যদেব দেখা দিলেন পূবে।যদিও বেশীক্ষণ সেটা স্থায়ী হয়নি।একটু পরেই মেঘের আড়ালে ঢেকে যায় সূর্য আবার।তবে সেই পাঁচ মিনিটের দেখাতেই মনে হয়েছিল ভোরে ওঠা সার্থক।

এরপর আবার বাড়ি ফেরার পালা।আবার নাগরিক জীবনের ডাক।আবার ছুটে চলা।ফেরার পথে সবাই কিছুটা সময় চুপচাপ ছিল।আমাদের গাড়িতে তখন বেজে উঠলো " তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব , ছেড়ে দেব না"।খুবই প্রচলিত একটি গান।বাউল গানই বলা যায়।কেষ্ট ক্ষেপা গেয়েছিল একসময়।অথচ আজকের দিনে দাঁড়িয়েও গানটা কতোটা তাৎপর্যবাহী আমাদের জীবনে চুপ করে বসে বসে ভাবছিলাম।পরে মনে হলো কাকে ছাড়বোনা ভাবছি কাকে রেখে দেবো বুকের ভেতর মনের ভেতর চিরকাল?উত্তর আমার কাছে ছিল।তবে সেটা বলার আর প্রয়োজন বোধ করিনি আর।ওয়াল্টার সলেস যিনি পরিচালক ছিলেন মোটোর সাইকেল ডাইরী মুভিটার,ওনার বলা একটা কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিল "It is about a journey of discovery that becomes one of self-discovery as well. It is about the emotional and political choices we all make in life. It's also about solidarity. Finally, it is about finding one's place in the world- one that is worth fighting for." 
হ্যাঁ তোমায় হৃদ মাঝারেই রাখব চিরকাল।
ভাল থেকো বন্ধু।



Going : Train From Howrah at 6am or Santragachi .
Train from Howrah to Mecheda . From Mecheda you can get bus taxi .
By car 175km from Kolkata via NH6 .
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post